বিচারপতি ফয়েজীর সনদ বাতিল
মোট ২৪০০ জালিয়াতির সনদ বাতিল করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জালিয়াতির অভিযোগে হাইকোর্টের বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়েজীর এলএলবি পাসের সনদ বাতিল করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়৷ গতকাল শনিবার সিন্ডিকেটের এক সভায় ফলাফল জালিয়াতির দায়ে ফয়েজীসহ প্রায় ২ হাজার ৪০০ জনের সনদ বাতিল করা হয়৷ সিন্ডিকেট বাতিল হওয়া সনদপত্র ফেরত নেওয়ার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরকে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাথর্ীদের চিঠি দিতে নির্দেশ দিয়েছে৷
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গতকাল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় পেশকৃত এ সংক্রানত্ম তদনত্ম কমিটির রিপোর্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর এ সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়৷ বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় হাইকোর্টে নিয়োগপ্রাপ্ত বিতর্কিত বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়েজীর এলএলবি পরীক্ষা পাসের পুরো বিষয়টিই যে জালিয়াতিতে ভরা ছিল তা আবারো প্রমাণিত হলো তদনত্ম কমিটির এ রিপোর্টে৷
উল্লেখ্য, ভোরের কাগজে ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর ‘এলএলবি পাস না করেই বিচারপতি! চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদনত্ম কমিটির রিপোর্টে বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়েজীর নাম’ শীর্ষক এক বিশেষ অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সারা দেশে তা নিয়ে ব্যাপক হইচই পড়ে যায়৷ গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩৯-তম সিন্ডিকেট সভায় সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক মোঃ সামসুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদনত্ম কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়৷ তদনত্ম কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫৩-তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধানত্ম বহাল রাখার সুপারিশ করে৷ সিন্ডিকেটের ৩৫৩-তম সভায় সিদ্ধানত্ম নেওয়া হয়েছিল, পূর্ববর্তী কমিটির প্রদত্ত প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাসমূহের ফলাফলের গেজেট সংশোধন করা হোক৷ উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের ফলাফল প্রকাশ করা হোক, অনুত্তীর্ণদের জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট বাতিল করা হোক এবং সেগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য তাদের চিঠি দেওয়া হোক৷ গতকালের সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধানত্ম হয় যে, যেসব পরীক্ষাথর্ী জালিয়াতির মাধ্যমে পরীক্ষায় পাস করে মার্কশিট ও সনদপত্র নিয়ে গেছেন তাদেরকে তা ফেরত দেওয়ায় জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে৷ পাশাপাশি দুনর্ীতি দমন কমিশনকেও তা জানানো হবে৷ তবে যারা ইতিমধ্যে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন তাদের ফলাফল প্রকাশের জন্যও সভায় সিদ্ধানত্ম গৃহীত হয়৷
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষাথর্ীর ফলাফল পাল্টে দেয় বলে অভিযোগ ওঠে৷ এ অভিযোগের পর ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তত্কালীন রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম এ সালেহকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদনত্ম কমিটি গঠন করে৷ কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম৷
এই কমিটি ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যনত্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন পরীক্ষার ১০ বছরের ফলাফলের অনিয়ম শনাক্ত করে এবং এলএলবি পরীক্ষার সাত বছরের ফলাফল (১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যনত্ম) যাচাই করে৷
পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে এই তদনত্ম কমিটি এলএলবির ১১১ জনের ফলাফল সংক্রানত্ম অনিয়ম খুঁজে পায়৷ তদনত্ম প্রতিবেদনে, ১৯৮৯ সালে এ ধরনের জালিয়াতিতে মাত্র একজন পরীক্ষার্থী আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ তদনত্ম কমিটির বিসত্মারিত প্রতিবেদনে কাটাকাটি, নাম্বার পরিবর্তন, স্বাক্ষরবিহীন এই একজন হিসেবে ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজের রোল নম্বর ৩৬৫২-ক অভিযুক্ত করা হয়৷ এই রোল নম্বর হলো ফয়সল মাহমুদ ফয়জীর৷
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ফয়সল মাহমুদ ফয়েজী ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যাালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এলএলবি প্রিলিমিনারি ও ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেন৷ ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তদনত্ম কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৫৩-তম সিন্ডিকেট সভায় কাটাকাটি, নম্বর পরিবর্তন, স্বাক্ষরবিহীন টেবু্যলেশন শিট এর জন্য ১৫ জন এলএলবি পরীক্ষাথীর অনিয়ম রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়৷ এই ১৫ জন পরীক্ষার্থীর টেবু্যলেশন শিটে কাটাকাটি বা ঘষামাজার পর তাতে স্বাক্ষর করা হয়নি৷ ওই ১৫ জনের মধ্যে বিচারক ফয়েজীও ছিলেন৷
গতকাল প্রায় ৮ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সিন্ডিকেট সভায় পেশকৃত রিপোর্টে ফলাফল জালিয়াতির মাধ্যমে পাস করার দায়ে হাইকোর্টের বিতর্কিত বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়েজীর নামও রয়েছে৷ এ ছাড়া আরো অনেক আইনজীবীর নামও রয়েছে৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক হেলাল নিবাসী গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদকের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুর্নাম হয়েছিল সিন্ডিকেটের এই সিদ্ধানত্মের ফলে আশা করি তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা হলেও মুক্ত হবে৷ প্রসঙ্গত, গত সাড়ে ৮ বছরে ৩৫৩-তম সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত সিদ্ধানত্ম বাসত্মবায়ন করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ৷ ইতিমধ্যে, ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট ফয়সল মাহমুদ ফয়েজী হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন৷
গতকাল শনিবার সিন্ডিকেট সভাপতি ও চবি উপাচার্য ড. বদিউল আলমের কাছে সিন্ডিকেটের সিদ্ধানত্ম সম্পর্কে মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে কোনো কিছুই বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, কার্যবিবরণীর অফিসিয়াল ডকুমেন্ট বের না হওয়া পর্যনত্ম আমি কিছু বলতে পারবো না৷ সিন্ডিকেটের ৩৫৩-তম সভার সিদ্ধানত্ম বহাল রাখার ব্যাপারে সিদ্ধানত্ম হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি শুধু হঁ্যা সূচক জবাব দেন৷ ফোনে এর বাইরে আর কিছুই বলতে চাননি তিনি৷
জানা গেছে, এলএলবি পরীক্ষার টেবুলেশন শিটে প্রাপ্ত নম্বরে কাটাকাটি, ঘষামাজার স্পষ্ট চিহ্ন থাকায় তদনত্ম কমিটির রিপোর্টের পরে ফলাফল শিটে ফয়সল মাহমুদ ফয়েজীর নাম ও রোল নং লাল কালিতে চিহ্নিত করে ‘ঝঃড়ঢ়’ লিখে দেওয়া হয়েছিল৷ ১৯৮৯ সালের এলএলবি পরীক্ষাথর্ী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৯০ সালে তিনি ৩য় বিভাগে পাস করেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ গত ৯-১২-৯০ তারিখে ফলাফল প্রকাশ করে৷ ঠিক তার পরদিনই অর্থাত্ ১০-১২-৯০ তারিখে ফয়সল মাহমুদ ফয়েজী তার সাময়িক সনদপত্র তুলে নেন৷ এর পরে তিনি তার মূল সনদ তোলার জন্য আর কোনো আবেদন করেননি বলে জানা গেছে৷