ক্যাম্পাসের জনপ্রিয় চরিত্র

ক্যাম্পাসের জনপ্রিয় চরিত্র

প্রত্যেক স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকে চটপুটি ওয়ালা, আচার ওয়ালা, ঝালমুড়ি কিংবা আরো নানা রকম ফেরিওয়ালা৷ তাদের উজ্জল উপস্থিতি শিৰার্থীদের মুখরোচক রসনা বিলাসকে শুধু তৃপ্ত করে না, করে আনন্দিতও৷ প্রয়োজনের সময় টাকা ভাংতি, টাকা ধার কিংবা শিৰার্থীদের নানারকম সহযোগীতায় তারা এগিয়ে আসে সাগ্রহে৷ আজ আমাদের ক্যাম্পাসে রয়েছে নগরির কয়েকটি শিৰা প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয় চরিত্র৷ লিখেছেন- রাবেয়া বেবী৷ ছবি- আনিসুল হক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় চরিত্র ঃ

চারম্নকলার দাদু ঃ ৬০/৬৫ বছরের বৃদ্ধ মোমিন আলী মৃধা এখন বয়সের ভার সামলাতে হাতে লাঠি নিয়ে চলাফেরা করেন ৷ দিনের অধিকাংশ সময়ই যার কাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারম্নকলা ইন্সটিটিউট চত্ত্বরে৷ দিন বদলের সাথে সাথে কখন যে তিনি চারম্নকলার সবার দাদু হয়ে গেছেন সে খেয়ালই নেই তার৷ চারম্নকলার প্রতিটি শিৰার্থী, শিৰক সবার কাছেই পরিচিত প্রিয়মুখ এই দাদু৷ দাদুর অবস্থান জানতে চারম্নকলার শিৰার্থী কিংবা আশপাশের দোকানের যে কাউকেই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন নিশ্চিত দাদু বর্তমান অবস্থান বলে দিতে পারবে৷ কথা হয় চারম্নকলার সেই পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ দাদুর সাথে৷ তিনি বলেন, আমার জন্ম শরিয়তপুর হলেও কাজের সন্ধানে ৩০/৩৫ বছর আগেই ঢাকা চলে আসি৷ ঢাকায় এসে কাজ নেই তখনকার ঢাকা ডিসট্রিক ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়িতে মালি হিসেবে৷ মেজিষ্ট্রেট সাহেবের বাসায় শিল্পী জয়নুল আবেদীন প্রায়ই আসতেন৷ সেই থেকেই জয়নুল সাহেবের সাথে আমার পরিচয়৷ আমাকে খুব ভালবাসতেন তিনি৷ জয়নুল সাহেবই তখন চারম্নকলায় এনে আমাকে মডেলের কাজ দেন৷ আয় বাড়াতে চারম্নকলায় মডেল হওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন পর থেকে মালা বিক্রি শুরম্ন করি৷ নিজেই মাটি দিয়ে নানা রকম মালা তৈরি করতাম আর বিক্রি করতাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরেই৷ এখন আর মালা বানাতে পারি না তবে এখনও মডেল হই৷ মডেল হওয়ার জন্য সরকারি ১০০ টাকা ছাড়াও যখন যে গ্রম্নপের মডেল হই তখন সে গ্রম্নপের শিৰার্থীরা ১৫/২০ টাকা করে দেয়৷ এভাবে সারাদিন চারম্নকলায় কাটিয়ে রাত ৮/৯ টার দিকে চলে যাই বাসায়৷ ব্যাক্তিগত জীবনে আমি তিন

সনত্মানের জনক৷ বড় ছেলে একটা মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করে, ছোট ছেলে চারম্নকলায় কিছুদিন লেখাপড়া করে আর করেনি৷ সেও একটা ছোটখাট ব্যবসা করে৷ আর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি বেশ আগেই৷ তবে সংসার জীবন আর চারম্নকলার জীবন নিয়ে বেশ সুখেই আছি৷ চারম্নকলার শিৰার্থী সুমন জানায়, চারম্নকলায় দাদুকে চেনে না এমন একজন শিৰার্থীও নেই৷ আমি চারম্নকলায় ভর্তি হয়েছি ৩ বছর হয়েছে৷ দাদুর সাথে আমার প্রথম আলাপ হয় আমাদের ক্লাসে৷ দাদু আমাদের গ্রম্নপের মডেল হয়েছিল৷ ক্লাশ শেষে দাদুর সাথে যেদিন আমার প্রথম আলাপ হয় সেদিন থেকেই দাদুর সাথে আমার এক অন্যরকম সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল৷ শুধু আমি কেন চারম্নকলার প্রতিটি শিৰার্থীর সঙ্গেই দাদুর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ন৷

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় চরিত্র ঃ

জাকির ভাই ও খালা ঃ জাবি’র বঙ্গবন্ধু হলের সামনেই প্রতিদিন চা বিক্রি করেন জাকির হোসেন৷ আর জাবির খালা খ্যাত হোসনে আরা চা বিক্রি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্ট্যান্ডে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে জাকির ভাইয়ের আগমন ৭/৮ বছর হলেও খালা এখানে চা বিক্রি করেন ১৪/১৫ বছর ধরে৷ তবে জাবির সবারই পরিচিত মুখ এ দুজন৷ বিভিন্ন হলের শিৰার্থী ছাড়াও অনাবাসিক শিৰার্থীদের কোলাহলে সর্বৰনই মুখর থাকে জাকির ভাইয়ের দোকান৷ জাকির ভাই বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রথম প্রথম ফ্লাস্কে চা নিয়ে ঘুইরা ঘুইরা বিক্রি করতাম৷ প্রায় দুই বছর এখানে এইভাবে চা বিক্রি করছি৷ এরপর এইখানকার ছাত্রদের সহযোগিতায় এই চায়ের দোকান দেই৷ সবাই আমারে খুব ভালবাসে৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শানত্মার নাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার সময় খালার চা না খেয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল কিনা তা নিয়েই সংশয়ে পড়ে যান৷ শুধু শানত্মা না বাসের জন্য জাবির বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেৰমান অনেক শিৰার্থীই বাসে উঠার আগে খালার হাতে এককাপ গরম চা খেয়ে তারপর বাসে উঠেন৷ খালা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বহু বছর ধইরা চা বিক্রি করি৷ এখানের সবাই আমারে খুব ভালবাসে৷

বরিশাইল্যা মামা ঃ বরিশালে বাড়ি হওয়ায় নিজের আসল নামটাও কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে গফুর মিঞার৷ তবুও এতটুকু খারাপ লাগে না যখন কোন শিৰার্থী এসে সৗেহে বলে মামা একটা চটপটি দিবেন? জাবির মেহের চত্ত্বরে ছোট্ট চটপটি আর ফুসকার দোকান বরিশাইল্যা মামার৷ সারাৰনই এখানে শিৰার্থীদের ভীর থাকে বরিশাইল্যা মামার চটপটি আর ফুসকা খাবার জন্য৷ মামা বলেন, ৮/১০ বছর ধরে আমি এখানে চটপটি বিক্রি করি৷ অনেক শিৰার্থীই বাকি খায় কিন্তু কখনো টাকা পয়সা নিয়ে আমার সাথে কোন বাকবিতন্ডা হয়নি৷ সবাই আমাকে খুব ভালবাসে৷

বদরম্নন্নেসা কলেজের চটপটি দাদু ঃ এ কলেজের ছাত্রী লুবনার ভাষায়- আমার সবচেয়ে পছন্দের হল চটপটি দাদু৷ চটপটি দাদুর নির্মল হাসি, সুন্দর ব্যবহার আর এই শ্রেনীর বয়স্ক একজন মানুষ হয়েও তার প্রগতিশীল চিনত্মাধারা ও মানুষিকতা আমাকে মুগ্ধ করে৷ মোঃ খায়ের নামের এই দাদু প্রায় চলিস্নশ বছর যাবত্‍ বদরম্নন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজে চটপটি বিক্রি করে আসছেন৷ ১৯৭২ সালের শেষ দিকে কলেজের একজন ছাত্রী নিপা আপার সহযোগিতায় প্রিন্সিপাল জাহানারা ম্যাডাম তাকে স্থায়ীভাবে দোকানদারি করার অনুমতি দেন৷ সেই থেকে কলেজের শিৰার্থী আর শিৰকদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক৷ তার বিচৰনতার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার ছাত্রীদের মোবাইল চোর ও টাকা চোরকে হাতে নাতে ধরে ফেলেন৷ মোঃ খায়ের বলেন, এই চলিস্নশ বছরে মেয়েদের জন্য আমার নিজের সনত্মানের মতই মায়া লাগে৷ কত মেয়ে যায়, কত মেয়ে আসে কাউকে আমার কাছে নতুন আর পুরনো মনে হয়না৷ রানি, মিতা আরও অনেক ছাত্রীর অভিমত আমাদের দাদুর মতো করে মজার চটপটি আর কোথাও খেতে পাইনা৷ তাই প্রায়ই বাড়িতে টিফিন বক্স ভরে নিয়ে যাই৷

ইডেন কলেজের চটপটি মামা ঃ এ কলেজের ছাত্রী উর্মি জানায়, বাসায় কারো সাথে বাজি ধরলে আমাদের কলেজের চটপটি খাওয়ানোর কথা বলি৷ আমার মা ও ভাই তাতেই খুশি৷ কারন আমাদের মামার চটপটি অসাধারন৷ মোঃ খোরশেদ জানান, প্রায় কিশোর বয়সে সে তার চাচার হাত ধরে ঢাকা শহরে আসেন৷ চাচা আবু তাহের সেই পাকিসত্মান আমল থেকে ইডেন কলেজে চটপটি বিক্রি করতেন৷ চাচার সহযোগী ছিলেন তিনি৷ চাচা ছিলেন কলেজের সবার প্রিয় দাদু৷ চাচার মৃতু্যর পর দোকান দেখাশুনার সম্পূর্ন দায়িত্ব চলে আসে খোরশেদের উপর৷ ধীরে ধীরে তিনি হয়ে যান সবার মামা৷ কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে খোরশেদ বলেন, অনেক সময় মেয়েদের কাছে ভাংতি টাকা থাকে না আমার কাছেও থাকে না৷ তখন বলি পরে দিয়ে যাবেন৷ প্রায় সবাই মনে করে আমাকে পরে টাকা দেয়৷ আমার মনেও থাকে না কার কাছ থেকে টাকা পাব৷ প্রতিদিন একপেস্নট চটপটি না খেলে যেন কলেজে আসাটাই অপূর্ন থেকে যায় বলে অনেক ছাত্রী জানায়৷

কবি নজরম্নল কলেজের শরবত মামা ঃ পুরনো ঢাকার সরকারি কবি নজরম্নল কলেজের গেটের সামনে ১০/১২ বছর ধরে শরবত বিক্রি করেন ফারম্নক হোসেন৷ শীত কিংবা গ্রীষ্ম সবসময়ই সকাল থেকে রাত অবধি তিনি শরবত বিক্রি করেন এখানে৷ যেজন্য কবি নজরম্নলের শিৰার্থীরা তাকে আদর করে ডাকেন শরবত মামা৷ গুর দিয়ে বানানো লেবুর শরবতে বরফের টুকরোর শীতলতায় অনেক শিৰার্থীকে শীতল করে শরবত মামার শরবত৷ শরবত মামা বলেন, নজরম্নল কলেজের সামনে বহু বছর ধইরা শরবত বিক্রি করি, এখানের ছাত্র শিৰকরা আমার শরবত খায় আর এইটাই আমার পেশা৷ দুইডা চাইল ডাইল কিনি এই শরবত বেচার পয়সা দিয়াই৷ কিন্তু বেশ কয়দিন হয় ঠিকমত দোকান লাগাইতে পারি না৷ দোকান লাগাইলে পুলিশে উঠাইয়া দেয়৷ এমনে চললে হয়তো আমারে এতদিনের শরবত বেচার পেশা ছাইরা অন্য পেশা ধরতে হইব৷

ঢাকা কলেজের আজিজ চাচা ঃ চায়ের একটি ফ্লাস্ক আর চিরার মোয়া নিয়ে ঢাকা কলেজ চত্ত্বরে সারাদিনই ঘোরাফেরা করেন আজিজ চাচা৷ ঢাকা কলেজের প্রতিটি শিৰার্থীর কাছেই আজিজ চাচা পরিচিত মুখ৷ ৮/১০ বছর ধরে ঢাকা কলেজে চা আর মোয়া বিক্রি কাজ করে আসছেন এই আজিজ চাচা৷ আজিজ চাচা বলেন, এখানে চা বিক্রির আগে আমি রিকসা চালাইতাম৷ এক্সিডেন্টে পা ভাইঙ্গা একমাসের মত হাসপাতালে ছিলাম৷ হাসপাতাল থেকে ফিরা চা বেচার কাম শুরম্ন করি৷ দুইবছর নিউমার্কেট নীলৰেত এলাকায় ঘুইরা ঘুইর চা বিক্রি করছি৷ মাঝে মধ্যে ঢাকা কলেজেও আসতাম৷ কিন্তু আজ প্রায় আট দশ বছর হইব এইখানেই চা বিক্রি করি৷ এখানকার সবাই আমারে চেনে, সবাই আমারে খুব ভালবাসে৷

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.