ননদ ভাবী সম্পর্কে নতুন মাত্রা
ননদ-ভাবীর ঝগড়া সেই পুরাতন দৃশ্যপটটা সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যাচ্ছে৷ যান্ত্রিক এই যাপিত জীবনে একই ঘরে প্রজন্মের দুই নারী এখন বড় আপনজন একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী৷ শিৰার আলোয় উদ্ভাসিত নারী একে অপরের হাত ধরে চলতে শিখেছে৷ তাই বদলে যাচ্ছে চিরায়ত সামাজিক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব-সংঘাত৷ নারীতে নারীতে তৈরী হচ্ছে সম্পর্কের মেল-বন্ধন৷ ননদ-ভাবীর পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপট
“ননদ-ভাবীর ঝগড়া”-এটা অনেকটা প্রবাদ বাক্যের মতোই ছিল৷ যে ঘরে ননদ অর্থাত্ বরের ছোটবোন থাকতো, সে ঘরে মেয়েরা বিয়ে করতে সংকোচবোধ করতো৷ ধরেই নিতো ননদটা খুব বদ মেজাজী, এক রোখা, কুটনী টাইপের হবে৷ সুতরাং ঝগড়া অনিবার্য৷ ননদও মনে হয় প্রস্তুত থাকতো চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের প্রখরতা দেখাতে৷ ভাবীও কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী নন৷ কিভাবে ঐ ননদকে হেনস্থা করা যায়-সেরকম শিৰা ও আশপাশের বয়োজৈষ্ঠদের কাছ থেকে নিয়ে আসতো৷ সুতরাং ভয়ের কোন কারণ নাই৷ শুধু একটু উছিলা পেলেই হয়৷ -এটা অবশ্য একটা সময়ের চিত্র৷ পারিবারির এই সমস্যাটি প্রায় প্রতিটা পরিবারেই ছিল৷ আমাদের সাহিত্যেও এর জোরালো প্রমাণ মেলে৷ শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে রাধা এবং তার ননদের ঝগড়ার যে বর্ণনা রয়েছে তা থেকে স্পষ্টই ধরে নেয়া যায় মধ্যযুগে পারিবারিক কলহের এই প্রকৃষ্ট বিষয়টি যথাযোগ্যভাবেই প্রবল ছিল, আর এজন্যই হয়তো কবি বড় চন্ডিদাসের দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টি৷ শুধু তাই নয়, যুগ যুগ ধরে সাহিত্যিকদের বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে বিষয়টি৷ যুগ বদলে গেছে৷ অশিৰা কুশিৰার অন্ধকারাচ্ছন্ন দেয়াল ভেঙ্গে নারী এখন সৃষ্টিশীলতায় তন্ময়৷ শিৰার আলো নারী হৃদয়ের কলুষতা দূর করে আলোকিত করেছে৷ নারী এখন শানত্মির খোঁজে দৃষ্টি নিৰেপ করে তেপানত্মরে৷ পারিবারিক ছোট্ট গন্ডির ভেতরের ছোট-খাট বিষয়গুলোকে সহজ সুন্দর ৰমার দৃষ্টিতে দেখতে শিখেছে৷ শানত্মির পায়রা উড়ানোর আগামীর প্রত্যাশায় নারী এ ঘর ছেড়ে ও ঘরে যায়৷ ননদের ছোট ছোট ভুলগুলো আনত্মরিকতায় শুধরে দিতে চায়৷ ননদও চায় ভাবীর একানত্ম সানি্নধ্য, বন্ধুর হাতছানি৷ একে অপরের সঙ্গী হতে চায় তারা৷ যেন পরিপূরক৷
হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করে স্বসত্মি পায় তারা৷ ভাগাভাগি করে দুঃখগুলো৷ নদদ ভাবী সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচন করেচেন ননদবাভীরা
লাভলী,
(ছাত্রী-ইডেন মহিলা কলেজ)ঃ
আশ্চর্য ভাবীর সাথে ঝগড়া করবো কেন৷ প্রশ্নই ওঠে না৷ ভাবী আমার বন্ধু, যাকে আমি সব কথা বলতে পারি, যার কাছ থেকে আমি যে কোন পরামর্শ, সাহায্য চাইতে পারি৷ দু’জনে মিলে-মিশে ঘরের কাজে সাহায্য করি৷ ভাবী কখনো আমাকে অন্যায়ভাবে কিছু বলেনি৷ এমন ভাবীর সাথে ঝগড়া করবো কেমন করে বলেন তো৷
নিরা (লাভলীর ভাবী)
ছোট বোনের সাথে কোন সুস্থ মানুষ সিরিয়াস ঝগড়া করে? লাভলী তো আমার ছোট বোন৷ ওর ভুলগুলো সুন্দর করে বোঝানোর চেষ্টা করি, এইতো৷
রিনি (তেজগাঁও কলেজ-হিসাববিজ্ঞান ২য় বর্ষ)
যারা অশিৰিত, মূর্খ-তারাই ভাবীদের সাথে ঝগড়া করে৷ আমিতো অশিৰিত না৷ আমার ভাবীরাও শিৰিত৷ সুতরাং ঝগড়ার কোন চান্স নাই৷
রিনির ভাবীরা
এখন কি আর সে যুগ আছে-ননদ-ভাবী, কেউ এখন কারো প্রতিপৰ বা শত্রম্ন নয়, বরং বন্ধু৷ রিনিকে কখনোই আমাদের কোন কাজের অনত্মরায় মনে করিনি৷ ও-ও কখনো আমাদের অসম্মান করে কথা বলেনি৷ এমন সম্পর্কে ঝগড়া সম্ভব? নিশ্চয়ই না৷
তানি (ছাত্রী, মিরপুর বাংলা কলেজ)
আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে, আমার ননদ থাকবে না৷ কারণ সর্বদাই স্বপ্ন দেখি, আমার ননদ-দেবর শ্বশুর-শাশুড়ী সবাই থাকবে, আমি আনত্মরিকতার সবটুকু ঢেলে দিব৷ আর তাছাড়া আমি আজ কারো ননদ, ক’দিন পর আমি কারো ভাবী হবো৷ সুতরাং আজ যদি আমি আমার ভাবীর সাথে খারাপ আচরণ করি, একদিন আমার সাথেও কেউ ঠিক অনুরূপ আচরণ করবে৷ এটা আমি বিশ্বাস করি৷ সুতরাং ভাবীর সাথে ঝগড়া বা বিরোধ আচরণ করে আমি আমার সুখ স্বপ্ন বা শানত্মি নষ্ট করতে রাজী নই৷ আর তাছাড়া বড় ভাবীকে আমি কখনোই অশ্রদ্ধা করবো না, কেননা যে মায়ের মতো আমাদের আগলে রাখার চেষ্টা করে, তাকে অসম্মান করার সাধ্য আমার নেই৷ শুধু আমি কেন পৃথিবীর কারো পৰেই সম্ভব নয়, আমার ভাবীর সাথে ঝগড়া করবে৷ কেন, কারণ আমার ভাবীরা খুব খুব খুব ভাল৷
এ্যানী (তানির ভাবী)
এই ননদের সাথে ঝগড়া করবে কে? ও শুধু মানুষকে ভালোবাসতে পারে, ঝগড়া করতে পারে না৷ ও-না থাকলে কি যে হয় ঘরটা, যেন ঠান্ডা বাড়ী৷ ঘরে থাকলে বুঝা যায়, ঘরে প্রাণ আছে৷ এমন ননদকে আদর না করে পারা যায়৷ ঝগড়া কি জিনিস ও এটা জানেই তো না৷ আমি বুঝি না, ননদ-ভাবীর রেষারেষিটা আসলে কিভাবে হয়, কেন হয়৷ ঝগড়ার যে কারণগুলো তৈরি হয়, তা এড়িয়ে গেলেই তো হয়৷ কারা ঝগড়া করে, যারা কম জানে, বা কম বুঝে৷
লাবণ্য (বদরম্নন্নেসা কলেজ)
ঝগড়া করার সময় আছে এখন৷ মানুষ এখন এতটাই ব্যসত্ম যে ঝগড়া করার যে প্রস্তুতি বা কূটকৌশল প্রয়োজন, তা মানুষের নেই৷ আর ভাবীর সাথে ঝগড়া করবো কোন দুঃখে৷ ভাবীর সাথে ঝগড়া করতে গেলে ভাবী ঠাস করে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবে৷ কিছুই বলার নেই, কারো কাছে নালিশ করারও উপায় নেই, কেউ আমাকে সাপোর্ট দেবে না৷ কেন? অদৃশ্য স্নেহের বাঁধনে ভাবী ঘরময় মানুষগুলোকে বেঁধে রেখেছে৷
লাবণ্যর ভাবীঃ
এটা আমার ঘর, আমার সংসার, ঘরের সমস্যাগুলো সমাধান করবো আমি, আমি কেন সমস্যা সৃষ্টি করবো৷ ননদ তো আমার মতোই একজন নারী৷ ওর সাথে তো ঝগড়া করার কিছু নেই৷ যারা করে তারা না বুঝে করে৷ নারী সর্বদাই শানত্মি প্রিয়৷ ছোট খাটো কারণে শানত্মি বিনষ্ট করার মানে হয় না৷
ব্যতিক্রমী হয়তো কিছু মানুষ থাকে৷ তারা কেন ঝগড়া করে বা এই অনাকাঙিৰত আচরণটি করে সংসারে অরাজকতার সৃষ্টি করে সে বিষয়ে কথা বলেছিলাম কয়েকজনের সঙ্গে-
হাবিবা (মনোবিজ্ঞান-৩য় বর্ষ, ইডেন মহিলা কলেজ) ননদ-ভাবীর ঝগড়ার প্রধান যে কারণটা আমার মনে হয়-সেটা হলো আধিপত্যের লড়াই৷ ননদ মনে করে আমি এ ঘরের মেয়ে, অথচ পরের বাড়ীর একটি মেয়ে এসে খবরদারী করবে, এটা হবে না, আবার দেখা যায়, সংসারের কাজের ৰেত্রে অনেক সময় ঘরের বউরা বা ভাবীটি অলসতা করে৷ শাশুড়ী অর্থাত্ ননদের কাজ করছে, এখনই ননদটি ভাবীর প্রতি রেগে গিয়ে কিছু একটা কটুকথা বলে ফেললো, তখনই ঝগড়ার সৃষ্টি হয়৷ আবার এর বিপরীতটাও লৰ্য করা যায়৷ ননদ ঘরের কাজে সাহায্য না করে উল্টো ভাবীর কাজের খুঁত ধরা কিংবা ছোট খাটো ঠাট্টার ছলেও অনেক সময় বড় ধরনের ঝগড়ার অবতারণা ঘটে৷ এৰেত্রে ননদ-ভাবী দু’জনকেই সহনশীল হতে হবে৷ সংসারের প্রতি আত্মিক টান থাকাটা এৰেত্রে ভাবীর জন্য জরম্নরী, আর ননদকেও ভাবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে৷ আমি মনে করি সুশিৰা এসব সমস্যাগুলো সমাধানে গতিশীল ভূমিকা রাখতে পারে৷
শশী (মনোবিজ্ঞান-শেষ বর্ষ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)ঃ
প্রতিটি পরিবারেই ছোটখাট এসব ব্যাপার ঘটে থাকে৷ এখন আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমি সংসারে অশানত্মি করবো না৷ যদি একটু ছাড় দিয়েও ঝগড়া এড়ানো যায়, তাহলে আমি সেটা করবো৷ আমি মনে করি এখন মেয়েরা অনেক উদার৷ শিৰা দীৰায় মেয়েরা অনেক এগিয়ে, আর সুশিৰা মানুষকে হিতাহিত জ্ঞান দেয়৷ সুতরাং হিতাহিত জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ পছন্দ করে না৷ আগে মানুষ অর্থাত্ মেয়েদের শিৰার অভাব ছিল বলে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে একে অপরকে প্রতিপৰ ভাবাতা৷ এখন দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হয়েছে৷