আজ কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ৬২তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৫৫ সালের এই দিনে তিনি বিক্রমপুরের মেদিনীম-ল গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুরের লৌহজং থানার পয়সা গ্রামে। তার লেখা অনবদ্য উপন্যাস ‘নূরজাহান’ তাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে, যা আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের বাংলাভাষী মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়।
শিল্পমানসম্পন্ন বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন ইমদাদুল হক মিলন। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার ও বিষয় বিন্যাসে তিনি সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনকে রূপায়ণ করেছেন। লেখকের অভিনবত্ব আবিষ্কারের জন্য আমাদের অবশ্যই তার আত্মজৈবনিক রচনা ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ (২০১২) পাঠ করে তার কথাসাহিত্যে প্রবেশ করতে হবে। কারণ এ রচনায় তিনি নিজের বেড়ে ওঠার কথা বলেছেন। তার গ্রাম, প্রকৃতি, আড়িয়ালবিলের জীবন, মানুষ, ভাষা, হাটবাজার সবই উন্মোচিত হয়েছে। একই সঙ্গে আদি ঢাকার সঙ্গে বিক্রমপুরের যোগাযোগ, লেখকের নিজের এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন, দেশভাগ, দাঙ্গা প্রভৃতি রূপ লাভ করেছে। এই স্মৃতি অভিজ্ঞতার পথ ধরেই তার বাল্য-কৈশোর-যৌবন উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি নিজের সৃজনশীলতার পথে অগ্রসর হয়েছেন। হয়তো এ কারণে প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ (১৯৭৬ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত) থেকে বিক্রমপুরের গ্রাম জীবনের কাহিনি রূপ লাভ করেছে।
গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সংলাপ ও বর্ণনায় আঞ্চলিক শব্দ অবলীলায় উপস্থাপিত হয়েছে সেখানে। গ্রামীণ নিম্নবর্গের কথায় তিনি তার মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। দেশভাগ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতার প্রকৃত চিত্র রয়েছে তার একাধিক উপন্যাসে। চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে ইমদাদুল হক মিলন সহানুভূতিশীল, হৃদয়বান, ভাষা সচেতন ও অনুভূতিশীল আখ্যান নির্মাতা। অনেক রচনায় বর্ণনাভঙ্গিতে নিরীক্ষাপ্রবণতা লক্ষণীয়। সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনি বর্ণনা করতে করতে একসময় উমাচরণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে উত্তমপুরুষ বর্ণনা পদ্ধতি সংযুক্ত হয়েছে প্রথম উপন্যাসেই। এভাবে মানবচরিত্রের অতলে ডুব দিয়েছেন তিনি। একদিকে গ্রামীণজীবন, মানুষ, প্রকৃতি; অন্যদিকে আধুনিক নগরজীবন, প্রেম, যৌনতা তার কথাসাহিত্যের মৌল উপজীব্য। আবার মুক্তিযুদ্ধ তার কথাসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। সেখানে তার দৃষ্টি ও ভাবনার জগৎ প্রসারিত; মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশামগ্ন সমাজের চিত্র একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অন্বেষায় তিনি নির্মোহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গল্পগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। মূলত তিনি নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামীণজীবনে নারীর অবস্থান চিত্রিত করেছেন দরদের সঙ্গে। প্রকৃতিময়তা ও দ্রোহ নারীর অবস্থান রূপায়ণে তার অনন্যতার স্বাক্ষর রয়েছে ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে; দ্রোহ চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে নূরজাহান। অন্যদিকে নারী ‘হাসু’র পুরুষ লিঙ্গান্তর আর ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসের বারিক-নয়নার সমকামিতা বাংলাদেশের উপন্যাসে নতুন চরিত্রের আস্বাদন এনে দিয়েছে। আরও আছে বিচিত্র পেশার মানুষের দারিদ্র্য ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের অভিব্যক্তি।
‘বাঁকা জল’, ‘ভূমিকা’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘রূপনগর’, ‘কালাকাল’, ‘টোপ’, ‘এক দেশে’, ‘বনমানুষ’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘পরাধীনতা’ ইমদাদুল হক মিলনের এই উপন্যাসগুলোর বিষয় বিচিত্র : মুক্তিযুদ্ধ, প্রবাসী শ্রমিক, কখনো গ্রামের ভেসে বেড়ানো অসহায় বালক অথবা পুরো একটা গ্রামই উপন্যাসের নায়ক। পাত্রপাত্রীর পেশা ও চরিত্র রূপায়ণেও বৈচিত্র্য রয়েছে। দিনমজুর বেলদার অথবা গ্রাম্য বাজারের ভাসমান নিম্নবর্গ, সার্কাসের জোকার, নদী ভাঙা মানুষ, পতিতাবৃত্তির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা কিশোরী পারুল যে শেষ পর্যন্ত জীবনের বিনিময়ে নিজেকে রক্ষা করে (‘টোপ’) এ রকম আরও অনেক চরিত্রের জীবন্ত উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মূলত ইমদাদুল হক মিলনের লেখক জীবনের বাছাই করা এ উপন্যাসগুলো নানা স্তরের গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপনের চিত্র হিসেবে বিশিষ্ট। জীবনের অনুভূতি ও উপলব্ধির ভাষা পাঠকের নিজস্ব সম্পদ করে তুলেছেন তিনি। কেন একজন লেখক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা পেয়ে যাই ঔপন্যাসিকের পাঠকের প্রতি সহৃদয়সংবেদ্য সঞ্চারি ভূমিকা, যা তিনি সহজ-সরল কথন বিশ্বে প্রসারিত করেন অজস্রতায়। মামুলি কথার আখ্যান থেকে তিনি নিজেকে প্রসারিত করেছেন সমাজ-রাজনীতির সংকটের গভীরে। ‘নূরজাহানে’র মতো বৃহৎ উপন্যাস লিখে লেখনীক্ষমতা ও মেধার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন।
ইমদাদুল হক মিলনের কয়েকটি উপন্যাসের কাহিনি এক প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছে, কিন্তু পরিণতিতে অন্য প্রসঙ্গ এসে জুড়ে বসেছে। ‘ঘেরাও’, ‘মহাযুদ্ধ’ প্রভৃতি উপন্যাসে সেই ত্রুটি স্পষ্ট। তবে তার গল্প বলার অভিনবত্ব সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয়। সাদামাটা গল্পকথনের ক্লিষ্টতা থেকে পাঠককে নতুন জগতে প্রবেশ করিয়েছেন তিনি। বিশেষত একই কাহিনিতে সর্বজ্ঞ লেখকের বর্ণনা থেকে বের হয়ে উত্তমপুরষের ‘আমি’তে গল্প বলেছেন অনেক ক্ষেত্রে। ভাষার সাবলীলতা, মানব জীবনের বিচিত্র সংকটের দরদি উপস্থাপন ও নানা চরিত্রের রূপায়ণে তিনি জনপ্রিয়। ইমদাদুল হক মিলনের মতে, লেখকের দায়িত্ববোধ বিশ্বের সব মানুষের জন্য। তাকে ভাবতে হয় সমাজ, দেশ, জাতি নিয়ে। সর্বোপরি সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে তাকে লিখতে হয় মানুষ নিয়ে। আর এই লেখার বিষয়বস্তু কোনো একটি দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না, হয় সর্বজনীন এবং বিশ্বের সব মানুষ নিয়ে। গ্রামীণ পটভূমিতে কথাসাহিত্যের বিষয় নির্মাণে তার ভাষার ওপর অধিকারের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। তার অনেক বর্ণনাই বাংলা গদ্যে নতুন সংযোজনা; প্রকাশভঙ্গিতে ভিন্ন স্বর সংযুক্ত। বিষয় ও প্রতীতি অনুযায়ী ভাষার স্থানিক উদ্ভাস নিজস্ব মেজাজে ব্যক্ত করেন তিনি; যা ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় অন্যান্য কথাসাহিত্যিকদের তুলনায় ভিন্ন, কিন্তু ইমদাদুল হক মিলনের কাহিনির জন্য অনিবার্য।
আমাদের সময়